ইতিকাফ আদায়ের ফজিলত ও বিধি-বিধান
আমাদের সকলের জীবন ভিন্ন ভিন্ন, বাস্তবিক অর্থে অনেকে খুবই ভালো, আবার অনেকে আছে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে বিভিন্ন সময়ে গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। পরে আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি আমাদের বিভিন্ন ইবাদতগুলোর মাঝে মাঝে। ঠিক এমন একটি ইবাদত হলো ইতিকাফ, যার মাধ্যমে খুব সহজে আল্লাহর কাছাকাছি এসে জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে নেয়া যায়।
ইতিকাফ কি?
ইতিকাফ শব্দের শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা। শরীয়াতের ভাষায় যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সহিত নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করার পদ্ধতিকে ই’তিকাফ বলা হয়। ইতিকাফ সবচেয়ে ভালো হলো যেখানে জুমার নামাজ আদায় করা হয় এমন মসজিদে আদায় করা। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজে ইতিকাফ করেছেন ও সাহাবীগনকেও ইতিকাফ করার জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
ইতিকাফের শ্রেনীবিভাগ
হানাফী মাযহাবের মতে ই’তিকাফ তিন প্রকার-
- ওয়াজিব ই’তিকাফঃ কেউ যদি মানতের ই’তিকাফ করে থাকে তাহলে তার জন্য ই’তিকাফ ওয়াজিব হবে, যেমন কেউ বলল আমার এ কাজটি যদি সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হয় তাহলে আমি এতদিন ই’তিকাফ করব। তাহলে তার ই’তিকাফ অবশ্যই ওয়াজিব হবে। তবে ওয়াজিব ই’তিকাফের জন্য রোজা রাখার শর্ত রয়েছে।
- সুন্নতে মুআক্কাদা (কিফায়া): রমজান মাসের শেষ দশকে যে ইতিকাফ করা হয়ে থাকে সেটাই মুলত সুন্নতে মুআক্কাদার ইতেকাফ। এ ধরনের ইতিকাফে গ্রমের যে কোন একজন যদি মসজিদে বসে ইতিকাফ আদায় করে তাহলে সকলের ইতিকাফ আদায় হয়ে যায়। আর যদি কেউ ইতিকাফ আদায় না করে তাহলে সকলে গুনাহগার হবে।
- মুস্তাহাব বা নফল ই’তিকাফঃ এ ধরনের ইতিকাফ যখন খুশি করা যায়, তবে এখানে রোজা রেখে ইতিকাফ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবে একদিনের বেশি সময় ইতিকাফ করা জরুরী। অর্থাৎ সর্বনিম্ন ২৪ ঘন্টার জন্য।
আরো পড়ুনঃ শবে কদরের ফজিলত ও শবে কদরের নামাজের নিয়ম
ইতিকাফ কেন করবেন?
আমরা যদি কোন অপরাধ করে ফেলি তার জন্য নিশ্চই কখনো না কখনো অনুতপ্ত হই। আবার অনেক সময় অনেকের কাছে মাফ চেয়ে বশি। অথবা মাঝে মাঝে এমন অপরাধ করে বসি যার জন্য পরে খুব অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে এমনভাবে ক্ষমা চাই সে মাফ করে দিতে বাধ্য থাকে। আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে এমন অনেক অপরাধ করে থাকি যার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে এমন ভাবে ওয়াদাবদ্ধ ভাবে ক্ষমা চাই যে এ কাজ আমি আর কখনো করবো না। আল্লাহর কাছে বান্দার ভূল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাওয়ার একটা একনিষ্ঠ পদ্ধতি মূলত ইতিকাফ। লক্ষ এমনভাবে স্থির করতে হবে যে আমি যে কোন প্রকারেই হোক আমার ভূল ত্রুটি ক্ষমা করিয়ে নিবোই।
ইতিকাফ আদায় করার ফজিলত ও উপকারিতা
আমাদের সমাজে এমন হয়ে গেছে ইতেকাফ করার মতো যোগ্য ব্যাক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না, যারা ইতকাফ করে তারা হয়তো অভাবে পড়ে কোন উপহার পাওয়ার আশায় ইতিকাফ করে, আবার অনেকে অন্যের জোরাজুরির কারনে ইতিকাফ আদায় করেন। কিন্ত ইতিকাফ আদায়ের উপকারিতা যদি আমরা মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতাম তাহলে মসজিদে ইতিকাফ আদায় করা নিয়ে ঝগড়া লেগে যেত। ইতিকাফ আদায় করলে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করা হয়, আর যেহেতু রমজান মাস তাই সওয়াব তো অনেক অনেক বেশি। আবার ইতকাফ যেহেতু রমজানের শেষ দশকে আদায় করা হয়, আর এ শেষ দশকের বেজোড় রাতে যেহেতু লাইলাতুল কদর হয়ে থাকে তাই ইতিকাফ আদায় করলে আমাদের শবে কদর পাওয়ার সম্ভবনা শতভাগ থাকবেই। শবে কদরের রাত যেহেতু হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম তাই কেউ এ রাতকে পেলে তার জন্য এটা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে যায়। সারাজীবনের সকল গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ পবিত্র মাহে রমজান মাসের ফজিলত ও ইবাদত।
ইতিকাফের সর্বোউত্তম স্থান কোথায়?
ইতিকাফের সর্বোচ্চ স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরীফ, এর পরে মসজিদে নববি, তারপর বাইতুল মুকাদ্দাস, এরপর জুমার নামাজ আদায় হয় এমন মসজিদ, আপনার এলাকায় যে মসজিদের মুসল্লি সবচেয়ে বেশি হবে সেই স্থানগুলো হলো ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান।
ইতিকাফের শর্তগুলো কি কি?
- মুসলমান হওয়া
- পাগল না হওয়া
- বালেগ হওয়া
- মসজিদে ইতিকাফ আদায় করা
- রোজা থাকা অবস্থায় ইতিকাফ করা ইত্যাদি।
ইতিকাফ অবস্থায় যে সকল কাজ করা যায়েজ
- ইতেকাফ কারীকে মসজিদে অবস্থান করতে হবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন যেমন- পেশাব, পায়খানা, গোসল, অজুকরা ইত্যাদি ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে মসজিদের বাহিরে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে।
- মসজিদে খাবার ও পানি পৌছানোর ব্যবস্থা না থাকলে বাহিরে গিয়ে খাবার খেতে পারবে, তবে খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকলে মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না।
- ইতেকাফকারী মসজিদে ইবাদতের পাশাপাশি আরাম আয়েশ ও ঘুমাতে পারবে।
- প্রয়োজনে পন্য সামগ্রি খরিদ করতে পারবে, কিন্তু খরিদের উদ্যেশ্যে পন্যসামগ্রি মসজিদে প্রবেশ করানো মাকরুহ কাজ।
- মহিলারা তাদের ঘরের কোনে নিরিবিলি কোন রুমে ইতিকাফ আদায় করবে, ইতিকাফ অবস্থায় নির্দেশ ও উপদেশের মাধ্যমে ঘরের কাজে সাহায্য করতে পারবে। তবে যতটা সম্ভব নিরিবিলি কোন দুনিয়াবি কথা না বলে থাকা যায়।
ইতেকাফ অবস্থায় আমাদের করনীয় কাজ সমূহ
- বেশি বেশি করে জিকিরে মগ্ন থাকা।
- কুরআন তিলাওয়াত বেশি করে কর।
- নফল নামাজ বেশি বেশি করে আদায় করা।
- দ্বীনি ওয়াজ নসিহত শুনে এর উপর আমল করা।
- ধর্মীয় গ্রন্থাবলি পাঠের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে প্রসিদ্ধ করা।
- নিজের আত্নিয়-স্বজন থেকে শুরু করে সকল মুসলমানের মুক্তির জন্য দুয়া করা।
- শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলিতে শবে কদরের তালাশ করা।
ইতেকাফ অবস্থায় আমাদের বর্জনীয় কাজ সমূহ
- ইতেকাফ চলাকালীন বিনা কারনে মসজিদের বাহিরে গিয়ে সময় কাটাতে পারবে না।
- দুনিয়াবি কোন প্রকার আলোচনায় লিপ্ত থাকা যাবে না।
- কোন জিনিসের বেচা কেনা করতে পারবে না।
- ব্যবসা বানিজ্যের হিসেব নিকেশ করতে পারবে না।
- অসুস্ত ব্যক্তির দেখাশুনার উদ্যেশ্যে বাহিরে বের হতে পারবে না।
- জানাজায় উপস্থিত হতে পারবে না।
- অকারনে কোথাও অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে পারবে না।
- স্ত্রীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা।
- স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হতে পারবে না, সেটা রাতে হোক অথবা দিনে।
যে সকল কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায় না
- ইতিকাফকারী কোন কারনে বাহিরে গেলে কেউ যদি তাকে আটকিয়ে রাখে অথবা কোন অজুহাত দেখেয়ি বিলম্ব করায় তাহলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না।
- ইতিকাফকারীর সামনে কেউ যদি পানিতে পড়ে অথবা আগুনে পড়ে মৃত্যুর সম্ভবনা থাকে এমন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না।
- ইতিকাফকারী আযান দেয়ার জন্য বাহিরের দরজা দিয়ে মিনারে প্রবেশ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না।
- মসজিদের পাশে পায়খানা প্রস্রাবের ব্যবস্থা থাকা সত্বেও দূরে নিজ বাড়িতে যেয়ে পায়খানা প্রস্রাব ও অজু গোসল করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না।
মহিলাদের ইতিকাফ
পুরুষদের মত মহিলারা ও ইতেকাফ করতে পারেবে। তবে তারা মসজিদে ইতেকাফ আদায় করবে না। তারা তাদের বাসায় নামাজ ঘরে ইতিকাফ আদায় করবে। কারো যদি নামাজের জন্য আলাদা কোন রুমের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে ঘরের কোন এক কোনে পর্দা দিয়ে জায়গাটাকে ঢেকে নিয়ে সেখানে ইতিকাফ আদায় করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে যে সকল রুমে বেশি লোকের আনাগোনা হয় এমন রুমকে পরিহার করা। তবে মহিলারা ইতিকাফের পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে আদেশ উপদেশের মাধ্যমে ঘরের কাজে সহায়তা করতে পারবে। বাদ বাকি সকল নিয়ম পুরুষ ইতিকাফ কারিদের মত হবে।
ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলতের বর্ননা শেষ করার মত নয়, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) শেষ দশকে কোমরে গামছা বেধে ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। সাহাবীগনকেও শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদত করতে বলেছেন। তাই আমরা রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ আদায় করে আল্লাহর কাছে সারা জীবনের সকল গুনাহের জন্য মাফ চেয়ে নিব। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইতিকাফে শামিল হওয়ার তৌফিক দান করুক।-আমিন।
উপায় কী এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url