পবিত্র মাহে রমজান মাসের ফজিলত ও ইবাদত

রোজা ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদত, রোজা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দেয়া ফরজ ইবাদতের একটি, এক কথায় রোজা একটি অতুলনীয় ইবাদত। রোজা রোজাদারের চরিত্রকে সংশোধন করে, রোজা রোজাদারকে ধৈর্য ধারন করার দক্ষতা অর্জন করে। রোজা ‘ফার্সী’ শব্দ, কুরআন ও হাদীসে রোজাকে সওম বলে অভিহিত করা হয়েছে। রোজা এর আভিধানিক অর্থ উপবাস করা, বিরত থাকা, সংযত হওয়া, বারণ করা বা ফিরিয়ে রাখা। রোজা মানুষকে পানাহার ও সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, শয়তানকে বান্দার কাছ থেকে ফিরিয়ে রাখে বলেই এর নাম সওম রাখা হয়েছে। হাদীস শরীফে সওম কে “ঢাল” বলেও অভিহিত করা হয়েছে। শত্রুর আক্রমন থেকে যেমন ঢাল রক্ষা করে রোজাও ঠিক তেমনি মানুষকে বিভিন্ন নফসের তাড়না ও শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা করে।

পবিত্র মাহে রমজান মাসের ফজিলত ও তাৎপর্য

রোজা কি?

ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, ইন্দ্রিয় তৃপ্তি এবং অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্চিত ও অশালীন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার কঠোর সাধনার নামই হলো রোজা। রোজার মাসকে পবিত্র কুরআনে রমজান মাস বলা হয়েছে। রোজার আভিধানিক অর্থ দহন করা বা জ্বালিয়ে দেওয়া। এটা বলার কারন হলো রোজা মানবজীবনের সকল খারাপ কাজগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। স্বর্ন যেমন যত বেশি পুড়ানো হয় তত বেশি খাঁটি হয় ঠিক তেমনি রোজা মানুষকে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার, পাপ পংকিলতা, হিংসা বিদ্বেষ, মিথ্যা, স্বার্থপরতা থেকে যেন আমরা বের হয়ে আসতে পারি রোজা এমনটাই শিক্ষা প্রদান করে আমাদের।



রমজান মাসের ফজিলত ও তাৎপর্য

রমজান মাসের রোজা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমান জাতির উপর ফরজ একটি আইন। রোজার ফরয হওয়া কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস থেকে সুপ্রমাণিত, হিজরিতে দেড় বছর পরে অর্থাৎ ২য় হিজরীতে রমযানের রোজা মুসলমানদের উপর ফরয করা হয়। আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন-

“ হে ঈমানদারগন, তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, ঠিক যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগনের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।” - সূরা আল বাকারা: ১৮৩

সুতরাং তোমাদের মাঝে যে ব্যাক্তি এ মাসটি পাবে সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোজা পালন করে। যেহেতু রোজা কুরআনে বর্নিত একটি ফরজ আইন। কেউ এটা অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যাবে এবং বিনা ওজরে কেউ রোজা না রাখলে সে ফাসিক ও কবীরা গুনাহের অধিকারী হবে। রোজা হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ন একটি স্তম্ভ। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মাঝে রোজাকে তৃতীয় ধরা হয়।

রমজান মাসকে মোট তিনটি অংশে ভাগ করা হয়, প্রধম দশ দিন হলো রহমতের অংশ, মধ্যবর্তী দশ দিন ক্ষমার অংশ বা মাগফিরাতের অংশ, এবং শেষ দশ দিন হলো দোযখ থেকে মুক্তির অথবা নাজাতের অংশ।

রমজানের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে রমজানে সকলের ‍গুনা মাফ করে নেওয়া যায়। রমজানে কেউ যদি রোজা রাখার নিয়ত করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় আল্লাহ তাআলা তার পুর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যারা রমজানে রোজা রাখবে রোজা রাখার প্রতিদান আল্লাহ নিজে দিবেন। পবিত্র রমজান মাসের ফজিলত এতটাই বেশি যে এ মাসে আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের আজাবকে এ মাসে বন্ধ করে রাখা হয় এবং এ মাসে শয়তানকে বন্ধি করে রাখা হয়। রোজাদার ব্যাক্তির মুখের গন্ধ মিশকের খুশবু অপেক্ষা আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দের। এ মাসে বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এ মাসে পবিত্র আল কুরআন নাজিল হয়েছিল। এ মাসে দু’আ কবুল করা হয়ে থাকে বেশি করে কারন রোজা রাখার কারনে আল্লাহর খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়।



রোজা কাদের উপর ফরজ?

রোজা প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন বিবেকবান, সুস্থ বালেগ মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ করা হয়েছে। রমজানের রোজা ফরজ হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান থাকা রোজা ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত। বিবেক বর্জিত কোন লোকের উপর শরীয়াতে রোজার বিধান আরোপ করা হয় নি। কোন প্রকারের ওজর ছাড়া সকল প্রকার লোকের উপর রোজা ফরজ।

রোজা ভঙ্গের কারনসমূহ

  1. কেউ রোজা অবস্থায় ভুলে কিছু খেয়ে ফেললে তারপর রোজা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।
  2. সাহরীর সময় আছে মনে করে কিছু খেয়ে নিলে, এরপর যদি দেখা যায় ভোর হয়ে গেছে তবে তার রোজা কাযা করা ওয়াজিব।
  3. যদি কেউ সূর্য ডোবার আগেই সূর্য ডুবে গেছে মনে করে ইফতারি করে অথচ এখনো সূর্য অস্ত যায়নি তাহলেও তার রোজা ভেঙ্গে যাবে।
  4. কেউ যদি মুখ ভরে বমি করে। অথবা মুখে বমি এলে যদি সেটা গিলে ফেলা হয়।
  5. নাকে বা কানে কোন কারনে তেল বা ঔষধ দিলে এবং যদি সেটা পেটে চলে যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
  6. কুলি করা বা অন্য কোন কারনে পেটে পানি চলে গেলে।
  7. বিড়ি- সিগারেটের ধোঁয়া নিজ ইচ্ছায় সেবন করলে।
  8. রোজাদারকে জোর করে কিছু খাওয়ালে।
  9. জোর পূর্বক স্ত্রীসহবাস করলে স্ত্রীর উপর শুধু কাজা কিন্তু স্বামীর উপর কাজা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
  10. মিসওয়াক করার সময় বা অন্য কোন কারনে দাঁত থেকে রক্ত বের হলে আর যদি তা থুতুসহ গিলে ফেলা হয়।

রোজা মাকরূহ হওয়ার কারন সমূহ

নিচে কিছু কারন উল্লেখ করা হলো এসকল কারনে রোজা নষ্ট হয় না তবে মাকরূহ হয়ে যায় এবং রোজার সওয়াব কমে যায়।
  1. স্বেচ্ছায় মুখে থুতু জমা করে একত্রিত করে গিলে ফেললে।
  2. বিনা কারনে কোনকিছু চিবান বা কোন বস্তুর স্বাদ গ্রহন করার পর খকখক করে থুতু ফেললে।
  3. টুথপেস্ট বা টুথপাউডার যাতীয় কোন রসসিক্ত মাজন দিয়ে দাঁত মাজলে।
  4. সিঙ্গা লাগানোর ফলে।
  5. গীবত ও কেউ কারো নামে নিন্দা করলে।
  6. অযথা ঝগড়া বিবাদ, গালি গালাজ ও অশ্লীল কথা- বার্তা বলা।
  7. স্ত্রীকে চুমু দেয়া, যদি চুমু দেয়ার ফলে শুক্রানু বের হওয়ার অশংকা থাকে।

রোজা না ভাঙ্গার কারনসমূহ কি কি?

  1. মিসওয়াক করা সেটা যা দিয়েই হউক না কেন।
  2. অনিচ্ছাকৃত ভাবে ধুলা-বালি, মশা-মাছি ইত্যাদির ধোঁয়া প্রবেশ করলে।
  3. শরীরে কোথাও তেল দিলে, যেমন- মাথায়, দাড়ি বা গোঁফে।
  4. চোখের মধ্যে সুরমা ব্যবহার করলে।
  5. আতর জাতিয় কোন কিছুর ঘ্রান তাৎক্ষনিকভাবে নিলে।
  6. দিনের বেলায় স্বপ্নদোষ হওয়ার কারনে।
  7. পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করলে, যদি পানি ভিতরে প্রবেশ না করে।
  8. বিশেষ প্রয়োজনে তরকারির স্বাদ গ্রহন করে ভালো করে মুখ পরিষ্কার করে নিলে।

সাহরী খাওয়ার উপকারিতা

মধ্যরাতের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যে কোন সময়ের মাঝে নিদ্রা ভঙ্গ করে পরের দিনে রোজা রাখার নিয়তে যে খাবার খাওয়া হয়ে থাকে তাকে সেহরী বলা হয়ে থাকে। সাহরী খাওয় সুন্নত এবং ভালো একটি সওয়াবের কাজ।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, তোমরা সাহরী খাও, কেননা এতে তোমাদের জন্য অনেক বরকত রয়েছে।- (বুখারী)। রাসুল (স.) আরো বলেছেন আমাদের ও ইয়াহুদীদের মাঝে তফাত হলো আমরা সাহরী করে থাকি অরা ইয়াহুদীরা সাহরী করে না। তাই আমরা গুরুত্ব সহকারে সাহরী খাবো। সাহরী শেষ রাতেই খাওয়া উত্তম।


ইফতার খাওয়ার উপকারিতা

সূর্যস্তের পর খুবই তারাতাড়ি মাগরিবের নামাজের আগে যে খাবার খাওয়া হয়ে থাকে তাকে আমরা ইফতার বলে থাকি। ইফতার করা মুস্তাহাব। অকারনে ইফতারে দেরি করা মাকরূহ একটি কাজ। খেজুর অথবা খোরমা দ্বারা ইফতার করা সুন্নত। কেউ যদি অন্য রোজাদারকে ইফতার করায় এটাও কিন্তু অনেক বড় সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। রাসুল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যাক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করায় সে ব্যাক্তির জন্য এত বেশি সওয়াব হয় যে তা মাগফিরাত ও দোযখের আগুন থেকে মুক্তির একটা কারন হয়ে যাবে এবং রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তাই আমরা চেষ্টা করবো যেন রোজাদারকে ইফতার করানো যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোজার গুরুত্ব

রোজা রাখার ফলে যে শুধু ইবাদত হয় শুধু এটাই না, রোজা রাখলে আমাদের শরীরের অনেক প্রকার খারাপ রোগের উপকার হয়ে থাকে। তবে আমরা অনেককে বলতে শুনি যে তারা রোজা নেই এর কারন তাদের এসিডিটির সমস্যা, মাথা ঘুরায়, বমি বমি ভাবে আসে, এগুলো হলো তাদের মনের রোগ। রোজা মূলত অনেক রোগের উপকার করে, যেমন- আলসার. ভুড়িওয়ালা লোকের ভুড়ি কমাতে, হৃদরোগ, কিডনী রোগীদের, কোষ্ঠকাঠিন্য, বহুমুত্র, ধুমপান থেকে বিরত থাকা, মদ্যপান, পান ও জর্দা সেবন করা ইত্যাদি সকল প্রকার কাজে রোজা রাখার ফলে উপকার পাওয়া যায়।

সুতরাং যেহেতু রোজার গুরুত্ব যেহেতু এতই বেশি তাই আমরা সকলে পবিত্র মাহে রমজানে সবগুলো রোজা খাঁটি দিল নিয়ে রাখার চেষ্টা করবো যাতে করে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া আমাদের জন্য সহজতর হয়ে যায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

উপায় কী এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url