শবে বরাতের ফজিলত- শবে বরাত হলো মুসলমানদের অন্যতম একটি খুশির দিন। শবে বরাতের অপেক্ষায় থাকে পুরো বিশ্বের মুমিন মুসলমানগন সারা বছর ধরে। এর কারন হলো শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত মুসলমানরা জানে। ইসলামী তমদ্দুন তথা আমাদের মুসলিম কৃষ্টিতে ৫টি রজনীর গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক। এ ৫ রজনীর মাঝে এক রজনীর নাম হলো শবে বরাত।
শবে বরাত মুলত একটি ফারসি শব্দ কারন এটি ফরাসি থেকে এসেছে। শবে বরাতের অর্থ হলো - ‘শব’ মানে রজনী বা রাত আর ‘বরাত’ শব্দের অর্থ হলো মুক্তি। তাহলে শবে বরাতের অর্থ দাড়ায় মুক্তির রাত। শবে বরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। আরবী মাসের শাবান মাসের গুরুত্ব অনেক। আর শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাতের রাত বলা হয়ে থাকে। হাদীস শরিফে এ রাতকে ‘নিসফ শাবান’ অথবা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়। তবে আমাদের দেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ রজনীনক ‘শবে বরাত’ নামেই সকলে চিনে থাকে।
২০২২ সালে শবে বরাত কত তারিখে?
শাবান মাসের মধ্য রজনী হলো শবে বরাতের রাত, সে হিসেবে শাবান মাসের ১৫ তারিখে আমরা শবে বরাত পালন করে থাকি। যেটা ইংরেজী মাসের ১৮ মার্চ ২০২২ দিবাগত রজনী। শুক্রবার দিবাগত রজনী এবার শবে বরাত পালন করা হবে।
শবে বরাতের ফজিলত:
- কোরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘হা-মিম’ শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা-দুখান- আয়াত: ১-৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন: ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমার রাতকেই বোঝানো হয়েছে।- ( তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরকারক থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে।- (মা’আরিফুল কোরআন)
- নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো ‘অর্ধ শাবানের রাত’। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।
- হাদিস শরিফে আছে, হজরত মু'আজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তা'আলা অর্ধ শাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দিয়ে থাকেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণ-কারী ছাড়া আর বাদবাকি সবাইকে ক্ষমা করে দেন।” (ইবনে হিব্বান- ৫৬৬৫, ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, রাজিন: ২০৪৮; ইবনে খুজাইমা, মুসনাদে আহমদ, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)
- হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) এর ভাষায় কোনো এক শাবান মাসের অর্ধ রাতে নবী করীম (সা.)- কে বিছানায় পাওয়া যাচ্ছিল না। খুঁজে দেখা গেল তিনি নামাজে দাঁড়ানো এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল, তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়শা, তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা -হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত’? আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
- হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ননা করা হয়েছে: নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। হযরত আয়শা (রা) আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের ( সংখ্যার পরিমাণের ) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।- ( তিরমিজি: ৭৩৯ )
- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনের বেলা রোজা পালন করবে। -( ইবনে মাজাহ )
- নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কারন, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহবান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব, এমন কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব, আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। -( ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪ )
শবে বরাতের নামাজ পড়ার নিয়মঃ-
শবে বরাতে কত রাকাত নামাজ পড়তে হবে এর নির্ধারিত কোন সংখ্যা কুরআন ও হাদীসে উল্ল্যেখ নেই। তবে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। যেহেতু সকল ইবাদতের শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নামাজ। সুতরাং নফল ইবাদতের শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নফল নামাজ। (ইবনে মাজাহ-১৩৮৪)
তাই এ রাতে দু’রাকাত করে নিয়ত করে যতখুশি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে আবার অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে আমরা নিয়ত করবো কি বলে, আমরা যারা আরবী জানি, “নাওয়াইতুআন উসুও লিল্লাহি তাআলা রাকাতি সালাতিল লািইলাতিল বরাতি মুতাওজ্যিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার” আল্লাহ যেহেতু সকলের মনের ভাষা বুঝেন, আমরা এভাবে বাংলায় নিয়ত করতে পারি, আমি কিবলামুখী হয়ে শবে বরাতের দুই রাকাত নফল নামাজের নিয়ত করছি আল্লাহু আকবার। আশা করছি এভাবে বললে আল্লাহ আমদের নামজকে কবুল করে নিবেন ইনশাআল্লাহ।
অনেকে বলেন শবে বরাতের নামাজে ‘সুরা ফাতিহা ’ পড়ার পর সুরা ইখলাস তিনবার অথবা সুরা ওয়াকিয়াহ পড়তে হবে । আসলে এর উপর তেমন কোন হাদীস পাওয়া যায় না। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এ ব্যপারে সুনির্ধারিত কিছু বলেন নি। সুতরাং আমরা আমদের জানা আছে এমন যে কোন সুরা দিয়েই নফল নামজ পড়ে ফেলতে পারি। তবে নামাজ কত রাকাত পড়লাম এটা যেন লোক দেখানের জন্য না হয় এবং যতরাকাত নামাজ পড়ি না কেন নামাজ যেন মনোযোগ দিয়ে পড়া হয় এটাই হলো মূখ্য বিষয়।
শবে বরাতের রোজার রাখার নিয়মঃ
হাদিস শরীফে শবে বরাতের রোজার বিশেষ ফজিলত পাওয়া যায়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং পরের দিন রোজা রাখো। সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয় একটি নফল রোজা রাখার কথা। এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন। রাসূল (সঃ) আমাদের কে নফল রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন। এ হিসেব করে শাবান মাসে তিনটি রোজা রাখা যেতে পারে।
এছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মাসের মধ্য তারিখ ও মাসের শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজাও এর আওতায় পড়ে। সাওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন যে- রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না।- (মুসলিম)
শাবান মাসে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) অধিকহারে রোজা রাখতেন। যেন তিনি পুরো শাবান মাসেই রোজা রাখতেন।- (তিরমিজি ১৫৫,১৫৬,১৫৯)
যেহেতু শাবান মাসের পরের মাস রমজান। আর রমজানে যেহেতু সকল মুসলমানদের রোজা রাখা ফরজ তাই আমরা যদি শাবান মাসে রোজা রাখার অভ্যাস করি তাহলে রমজান মাসে রোজা রাখা আমাদের জন্য অনেক সহজতর হয়ে যাবে।
শবে বরাতে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় কাজঃ
আমাদের করনীয়: (ক) নফল নামাজ , যেমন-তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, ছলাতুল হাজাত, ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।
(খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। (গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা, (ঘ) কোরআন শরিফ- যেমন: সুরা দুখান সহ অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা, (ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া, (চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; (ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকারে লিপ্ত থাকা, দান সদকা করা ইত্যাদি, (জ) কবর জিয়ারত করা; (ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
আমাদের বর্জনীয় কাজ সমূহ: (ক) আতশবাজি ও পটকা না ফোটানো, (খ) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা না করা, (গ) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস না করা, (ঘ) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ না করা, (ঙ) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন না ঘটানো, (চ) হালুয়া-রুটি বা অন্য খাওয়া-দাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট না করা।
আমরা দিন দিন ইসলামের পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এমন অনেক ব্যক্তি এক বছর আগে এ পৃথিবীতে জীবিত ছিল আজকে তারা কেউ নেই, আমরাও যে এর পরের বছর শবে বরাত পাবো এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। আর শাবান মাসের পরের মাস যেহেতু রমজান আমরা শবে বরাতে আল্লাহর কাছে এ দুআ অবশ্যই করবো যেন আল্লাহ আমাদের কে রমজান পর্যন্ত জীবিত রাখেন এবং রমজানের ফজিলত গুলো হাসিল করার তৌফিক দান করেন।-
আমিন
আরো পড়ুন:
উপায় কী এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url